সম্প্রতি পূর্ব মেদিনীপুরের একটি বিদ্যালয়ে একটি ছাত্রকে (মুস্তাকিন সাহা) বহিষ্কার করা হল। সোশ্যাল মিডিয়াতে ভীষণ ভাবে ভাইরাল হয়েছে সেই ভিডিও, সেখানে দেখা যাচ্ছে ছেলেটির উদ্ধত আচরণ। ছেলেটি তর্ক করছে শিক্ষক মহাশয়ের সাথে। ছেলেটি দেরি করে বিদ্যালয়ে এসেছে। প্রাথমিক ভাবে এটা জানা গেলেও পরে জানা গেল ছেলেটি টিফিন-এর পর স্কুলে আসে এবং ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করে। (যদিও ভিডিওটিতে এইরকম কিছু দেখা যায় না) অভিযুক্ত ছেলেটিকে কমন রুমে-এ এনে জিজ্ঞাসাবাদের সময় শোনা যায় - ছেলেটি বলছে তার “চুল ধরতে পারবেন না” এবং একটি শিক্ষকের উদ্দেশ্যে বলে-“দম থাকলে মাঠে আসুন”। একজন শিক্ষক বলেন-”তোর লিমিট কত দূর?” ছেলেটি বলে- “পুরো দীঘা আমার লিমিটে আছে, আজকে বেরিয়ে দেখুন”। যাইহোক এই ধরণের কথাবার্তা আমরা ভিডিওটিতে দেখতে পাই। পরে জানা গেল এই ঘটনার সাথে যুক্ত শিক্ষক মহাশয়কে নাকি সে মারধরও করেছে। এটি একটি গুরুতর অভিযোগ যার সত্যতা কতখানি তা বিচার্যের বিষয়। বর্তমানে ছেলেটি বহিষ্কৃত হয়েছে।
অতএব বিদ্যালয়ের সীমানার মধ্যে সে আর ঢুকতে পারবে না। বই খাতার সঙ্গে তার যেটুকু সম্পর্ক, এই বিদ্যালয়ে যাওয়ার মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল তা ছিন্ন হল। বিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত এই ছেলে সমাজ থেকেও বিতাড়িত হতে থাকবে ধীরে ধীরে। ক্ষণিকের ঔদ্ধত্য, অজ্ঞতা, অসংযমীতা হয়ত তাকে ঠেলে দিল এক অন্ধকারময় জীবন পথে কিন্তু অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যাওয়ার জন্যই তো আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। মহান শিক্ষকদের শিক্ষাদানের মূল উদ্দেশ্যই তো অজ্ঞতা কে দূর করা। প্রতিকূল স্রোতে ভেসে যাওয়া মানুষকে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা অর্থাৎ এক বিজ্ঞ মানুষ তৈরি করা।
কিন্তু না, মহান শিক্ষকদের উদ্দেশ্য হয়ত তা নয়। তাদের মূল উদ্দেশ্য হল বিষয় ভিত্তিক শিক্ষাদান। বাংলা, ইংরাজী, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, গণিত এই বিষয় গুলি ছাত্রছাত্রীদের আয়ত্ত করান।
এই পুঁথিগত শিক্ষার মূল্য অবশ্যই আছে। এই বিষয় গুলির উপর গভীর অথবা সাধারণ ধারণা প্রত্যেকটি ছাত্র ছাত্রীর থাকা বিশেষ প্রয়োজন। কারণ ভবিষ্যৎ জীবনের কর্মসংস্থান এর উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠবে। আমাদের মহান শিক্ষক মহাশয়েরা এই বিষয়ের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেন। কারণ তারা বিশ্বাস করেন এই বিষয়গুলি রপ্ত করতে পারলে ও পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়ে কৃতকার্য হলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। তাঁদের কাছে এটাই হোল শিক্ষার মূল্য বা লক্ষ্য এবং আমাদের সমাজে বেশীর ভাগ মানুষই শিক্ষার উদ্দেশ্য বলতে এইটাই মনে করেন। তাই বর্তমানে শিক্ষকদের শিক্ষাদান এই সংকীর্ণ গন্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যদিও সমাজের এই হীন মানসিকতার ঊর্ধ্বে অবস্থান করাই শিক্ষক মণ্ডলীর কাম্য ছিল।
তাঁদের শিক্ষাদানের পদ্ধতি নিয়ে কিছু বলতে চাই না। তবে কিছু আচরণগত দিক আছে যেগুলি বেশীর ভাগ সময় লক্ষ্য করা যায় - সাধারণত শিক্ষক মহাশয়েরা বিষয়ের প্রতি আগ্রহী ও মনোযোগী ছাত্রছাত্রীদের উপর বিশেষ যত্নশীল হন। অপর দিকে অনাগ্রহী বা অমোনযোগী ছাত্রছাত্রীদের প্রতি উদাসীন থাকেন।
তাদের তিরস্কার ও শাস্তি প্রদান করা ছাড়া অন্য কোন উপায় অবলম্বন করতে দেখা যায় না। আর অতিরিক্ত কিছু ঘটনা ঘটলে অভিভাবকদের নালিশ জানান তাঁরা।
শাস্তি এবং তিরস্কার হল একটি সাময়িক উপশম। ঠিক পেইনকিলার এর মতন এর উপকারিতা কিছুক্ষণের জন্য স্থায়ী। মূল চিকিৎসা এটা নয়। চিকিৎসকেরা বলেন এই পেইনকিলার বেশী প্রয়োগের ফলে আরও জটিল রোগের কবলে পরার সম্ভাবনা থাকে। অতএব ছাত্রছাত্রীরা কেন অমোনযোগী হচ্ছে, কেন তারা অনাগ্রহী হচ্ছে এর মূল কারণ অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা বা ইচ্ছা যদি শিক্ষকগণের মধ্যে না থাকে তাহলে এ রোগের উপশম হবে না। ফলে বিষয় ভিত্তিক জ্ঞান যেটিকে এঁনারা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন সেটিও অসম্পূর্ণ থেকে যায়,বড়ো সংখ্যক ছাত্রছাত্রীদের কাছে। ভবিষ্যৎ কর্ম জীবনে এই অসম্পূর্ণ শিক্ষার প্রভাব তারা প্রতক্ষ্য করে এবং হতাশায় ভোগে ও পরিণত বয়সে এসে নিজেদের দোষারোপ করে। শিক্ষকগণেরা একটা দীর্ঘ সময় পান এই পরিণতি থেকে ছাত্রছাত্রীদের রক্ষা করার কিন্তু তাঁরা এ বিষয় মোটেই চিন্তিত নন।
তাঁদের আচরণের আরেকটি দিক হলো-তাঁরা মুক্ত কন্ঠে বলে থাকেন- আমি শ্রেণিকক্ষে সমস্ত কিছুই শিখিয়েছি আপনার সন্তান যদি গ্রহণ করতে না পারে, আমার তো কিছু করার নেই।
ছাত্র বা ছাত্রীরা অকৃতকার্য হলে তার দায় তারা গ্রহণ করেন না। তবে সফল হলে কৃতিত্বের দাবি জানাতে তাঁরা ভোলেন না। কৃতিত্ব যে একেবারেই নেই সেটা বলা ঠিক নয়। দক্ষ শিক্ষক আছেন। বিষয়ের প্রতি অগাধ পাণ্ডিত্য আছে এমন শিক্ষকও দেখা যায়। কিন্তু কতটা নিষ্ঠা ও সততার সাথে তিনি তা বিতরণ করেন তা সন্দেহাতীত নয়। আদর্শ রাষ্ট্র নায়কের যেমন উচিৎ দেশের শেষ প্রান্তে অবস্থিত নাগরিকটিরও খেয়াল রাখা ও তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা সেই রকম পিছিয়ে পড়া সেই সকল ছাত্রছাত্রীদের প্রতি নজর দেওয়া শিক্ষক মহাশয়দের নৈতিক কর্তব্য।
শিক্ষকদের বিদ্যালয়ে ছাত্র অসন্তোষসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কোন ছাত্রের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহার অপমান জনক কথাবার্তা কখনই কাম্য নয়।এক্ষেত্রে উচিত উপস্থিত বুদ্ধি ও অন্তদৃষ্টি দিয়ে কোন্ সমাজ, কোন্ পারিবারিক পরিমণ্ডল ও কোন্ আর্থসামাজিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে ছেলেটি বড় হয়েছে তা বিশ্লেষণ করে বাস্তব বুদ্ধি ও কৌশল দ্বারা তার ঐ আচরণ কে নিয়ন্ত্রনে আনা। ক্ষমাশীলতা, সহিষ্ণুতা, প্রসন্নতা এই মানবিক গুণে বলিয়ান হয়ে শিক্ষার্থীদের চরিত্র গঠন ও ভবিষ্যতে এক সৎ, সুন্দর মানুষ তৈরি করাই শিক্ষকদের প্রধানলক্ষ্য হওয়া উচিত, যা হল শিক্ষার মূল লক্ষ্য।
বুদ্ধির তারতম্যের জন্য বা জৈবিক কারণে সকল শিক্ষার্থীর সমান মেধা হয় না। নির্দিষ্ট একটি শিক্ষা গ্রহণ করার মানসিক ক্ষমতাও সবার থাকে না। যার ফলে বিভিন্ন জন বিভিন্ন পেশায় অগ্রসর হয়। যেহেতু কোন পেশাই ছোট নয় এবং সমস্ত শ্রেনীর মানুষেরই সমাজে বিশেষ প্রয়োজনীয়তা আছে তাই কেউ যদি ডাক্তার, উকিল, শিক্ষক, বাজারের সবজী বিক্রেতা বা রাজমিস্ত্রীও হয়, তাতে কোন অসুবিধা নেই। তাঁদের মধ্যে যদি সততা থাকে এবং তারা যদি কর্তব্যনিষ্ঠ হয় তাহলে সমাজ সুন্দর হবে। অন্যথায় সমাজ দুর্নীতিগ্রস্থ হবে। অতএব ছাত্রছাত্রীদের আচার ব্যবহার, তার অসৎ প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করার গুরু দায়িত্ব শিক্ষকদের। বেয়াদব ছাত্রকে বহিষ্কার করে তাকে শাস্তি দেওয়া নয়।
পূর্ব মেদিনীপুরের সেই স্কুলে দেখা যাচ্ছে একজন শিক্ষক মহাশয় উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করছেন- “ছেলেটিকে আমরা বহিষ্কার করলাম”। এটি অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। ছেলেটি দীর্ঘদিন ধরে স্কুলে আসছে, এই দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত প্রাজ্ঞ শিক্ষকগণ ষোলো-সতের বছরের একটি ছেলেকে সামলাতে পারলেন না! নতি স্বীকার করলেন, ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে কাপুরুষের মত ক্ষমতা প্রয়োগ করলেন এবং সর্বোচ্চ সাজা ঘোষণা করলেন।
সবাই বিদ্যাসাগর রচিত ‘গোপাল’ চরিত্রের মতন সুবোধ বালক হয় না, দুষ্টু রাখালের মতনও বালক থাকে। দুষ্টু বালক কে সুবোধ বালকে পরিবর্তন করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা শিক্ষকদের উচিত নয় কি? অনেকে বলছেন ঐ ছেলেটির কোন পরিবর্তন হবে না। এই কথাটি যুক্তিসম্মত নয়। পৃথিবী বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কিছুই পরিবর্তনশীল। জৈবিক বা অজৈবিক সব কিছুই। ছেলেটির এই রকম আচরণ নির্দিষ্ট একটি সময়ের মানসিক অবস্থা মাত্র। আমরা জানি সময়ের সাথে সাথে অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে মানুষের চিন্তা ভাবনার পরিবর্তন ঘটে। যেহেতু সে একটি মানুষ অর্থাৎ চিন্তাশীল প্রানী সে বিপরীত চিন্তাটাও এক সময় করবে। এই সময় তার মানসিক চিন্তার যে বক্রতা তা সোজা পথে নিয়ে যেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে কিন্তু সেটা অসম্ভব নয়। তার জন্য দরকার আদর্শ শিক্ষকের যার মধ্যে থাকবে মানবিকতার গুণ। স্কুলের পাঠক্রম শেষ করার তৎপড়তার চেয়েও বেশী শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ জাগ্রত করার সদিচ্ছা। হিংসা বা দস্যু প্রবৃত্তি সমস্ত মানুষের মধ্যেই বর্তমান। আমরা এখন এই ছেলেটির কথা ভাবছি, সমাজবিরোধীদের দলে তাকে ফেলছি, তাকে বিদ্যালয় থেকে দূরে রাখছি কারণ সে অযোগ্য। কিন্তু যোগ্য ছাত্রছাত্রীরাও বিদ্যালয় থেকে সফল ভাবে কৃতকার্য হয়ে এবং পরবর্তী ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও সমাজবিরোধীতার কাজে যুক্ত হয়ে সমাজের ক্ষতি সাধন করে চলেছে এমন সংখ্যাও কম নয়। অতীত বা বর্তমান সময়কালে আমরা দেখেছি উচ্চপদস্থ বহু কর্মচারী দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কিন্তু উচ্চশিক্ষিত। অতএব ভবিষ্যতে একটি ভালো শিক্ষার্থীর মন্দদিকে আবার একটি মন্দ শিক্ষার্থীর ভালোদিকে অগ্রসর হওয়ার উভয় সম্ভাবনা থাকে। গোড়াতেই একজন ছাত্রছাত্রীর সঠিক চারিত্রিক মূল্যায়ন করে তাকে মন্দ পথে অগ্রসর হওয়ার প্রবনতাকে যদি কম করা যায় বা নির্মূল করা যায় তবে সেটাকেই শিক্ষার অগ্রগতি বলে চিহ্নিত করা যাবে।
শিক্ষাবিদরা বলেন শাস্তি দেওয়ার প্রবনতা তখনই আসে যখন শিক্ষক বা শিক্ষিকা অক্ষম হয়ে পড়েন। (আমি এখানে চরম শাস্তির কথা বলছি, যেমন স্কুল থেকে বহিষ্কার) “Infliction by punishment is the teachers failure” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন “রাষ্ট্রতন্ত্রই হোক বা শিক্ষাতন্ত্রেই হোক, কঠোর শাসননীতি শাসয়িতার অযোগ্যতার প্রমাণ”।
একটি আদর্শ শিক্ষকের পাঠদান ছাড়া যে আবশ্যিক গুণগুলি থাকা প্রয়োজন বা যে নীতি মেনে চলা উচিত সেগুলি হল - সত্যবাদিতা, নিরপেক্ষতা, সম্মান প্রদর্শন করা, ধৈর্যশীলতা, সহিষ্ণুতা। এই গুণগুলি সাধারণ মানুষের থেকে তাঁদের পৃথক করে এবং এক নক্ষত্রসম বিরাটত্বের আসনে তাঁরা বিরাজ করেন। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ তাঁদের ঐ রকম এক উচ্চস্থানে রাখেন এবং ওঁনারা এই বিষয়টি বেশ উপভোগ করেন ও বিশেষ ক্ষেত্রে এর যথার্থ সদ্ব্যবহারও করে থাকেন। তাঁদের বর্তমান আর্থিক অবস্থা ও এই রাজকীয় সম্মানের দ্বৈত মিলনের দম্ভে তাঁরা মনে করেন তাঁরা সমালোচনার ঊর্ধ্বে। তাঁদের কিছু বলা যাবে না কারণ তাঁরা শিক্ষক অর্থাৎ দেবতুল্য।
আমি মনে করি সাধারণ মানুষ থেকে শিক্ষকের আসন এবং পরবর্তী ক্ষেত্রে দেবতার আসনে স্থান পাওয়ার এই ক্রমবিবর্তন তাঁদের শিক্ষকের আদর্শ থেকে বিচ্যুত করেছে। যে নক্ষত্রসম বিরাটত্বের আলোয় অন্ধকার দূর হওয়ার কথা,সে নক্ষত্র আর নেই। পরিণত হয়েছে একটা গ্রহে বা উপগ্রহে যার নিজস্ব কোন আলো নেই,আছে শুধু “শিক্ষক”নামের একটি মুকুট। যেটি শিক্ষকের অবভাস (Appearance) বা প্রতিলিপি মাত্র। ঐ শিক্ষক নামক মুকুটের ম্লান আলোয় দিকভ্রান্ত কোন ছাত্র সঠিক পথের দিশা খুঁজে পায় না, ভুল পথে পরিচালিত হয় এবং সব শেষে বহিষ্কৃত হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থ বলেছেন “একটি প্রদীপ অন্য প্রদীপকে তখনই প্রজ্বলিত করতে পারে যখন সে নিজ শিখায় দীপ্যমান থাকে”।
কালিকাপুর, বজবজ